সম্প্রতি মন্ত্রী পরিষদ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ২০২২ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে গাছ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল করেছে। ইতিপূর্বে এরশাদ জামানায় এ সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেছিল সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজি রক্ষার জন্য। সে সময়ের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদকাল আগামী ডিসেম্বর মাসে শেষ হবে। তাই বর্তমান মন্ত্রী পরিষদ ২০২২ সাল পর্যন্ত বৃক্ষ নিধনের উপর নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপ করেছে। যা কার্যকর হবে ২০১৭ সালের জানুয়ারী থেকে। বর্তমান সময়ের জন্য আইনটি সময়োপযোগী। এভাবে আইন প্রণয়ন না করলে দেশের অবশিষ্ট বনাঞ্চলে প্রাকৃতিক ও সৃজিত বনের গাছপালা রক্ষা পাবে না। গাছ কাটা বন্ধ করার পিছনে অনেক যুক্তি আছে। গাছ না থাকলে পরিবেশ বিপন্ন হবে। মনীষীদের অভিমত, এক বছরের জন্য কিছু করতে হলে শস্য বপন করতে বলেছে। আর কয়েক যুগের জন্য কিছু করলে বৃক্ষ রোপন করতে বলেছে। সারাজীবনের জন্য কিছু করতে হলে ছেলেমেয়েদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ও সৃজিত বেশিরভাগ বৃক্ষের অস্থিত্ব নেই পাহাড়গুলোতে। ইতিমধ্যে বনদস্যুদের থাবায় বিশাল বিশাল বনভূমি বিরামভূমিতে পরিণত হয়েছে। যৎসামান্য অবশিষ্ট থাকলেও প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে। এক সময়ের তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজার চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ও সরকারী অর্থায়নে বনবিভাগ কর্তৃক সৃজিত গাছপালা নেই বলাই চলে। বেশিরভাগ বনশূন্য পাহাড় দেখলে মনে হয় যেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ভান্তের মাথার মত। অতিবর্ষণজনিত কারণে এসব ন্যাড়া পাহাড়ের মাটি ভেসে এসে খাল-বিল, নদী-নালা ও সমুদ্রের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রীতি সরকার ন্যাড়া পাহাড়ে বনায়নের জন্য উপকারভোগী নির্ধারণ করে সামাজিক বনায়নের কার্যক্রম শুরু করলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামাজিক বনায়নে সফলতা আসছে না। একদিকে গাছ উজাড় অন্যদিকে বনভূমি দখল হচ্ছে সমানে। এক্ষেত্রে বনবিভাগ অনেকটা বলীর পাঠা। কারণ যেসব সময় যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, সে সরকারের হাইব্রিড নেতা-কর্মীদের দাপটে বনবিভাগের ইচ্ছা থাকলেও যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। আবার সব ক্ষেত্রে বনবিভাগ যেমন দায়ী নয়, তেমন সব কর্মীরা ধোয়া তুলসীপাতাও নয়। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার অনুদানে এ পর্যন্ত কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে পরিমাণ সামাজিক বনায়ন করা হয়েছে, তার বাস্তব অবস্থা কি সরেজমিনে পরিদর্শন না করলে বুঝা যাবে না। এক্ষেত্রে বিদেশী অর্থ ব্যয় করা হলেও মাঠ পর্যায়ে কি অবস্থা তা অনুসন্ধান করা জরুরী। কথায় আছে ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নাই অবস্থা।’ নদী ভাঙন ও ভূমিহীনদের নাম ভাঙ্গিয়ে ইতিমধ্যে বেশুমার বনভূমি বেদখল হয়ে গেছে। এসব বনভূমি দখলদারেরা মোটা অংকের টাকায় বেচা-বিক্রিও করছে। সম্প্রতি কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের উচিতারবিল এলাকায় আগর বাগান উজাড় করে বিশাল বনভূমি দখল-বেদখলের তান্ডবলীলা চলছে। বনবিভাগ অনেক কাঠ খড় পুড়িয়েও উজাড়কারীদের রাহুগ্রাস থেকে আগর বাগানের বনভূমি রক্ষা করতে পারছেনা। বনবিভাগ এসব অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়েও সফল হচ্ছে না। বেশিরভাগ বনভূমি দখল হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আশীর্বাদে। দায়িত্বশীল এক ব্যক্তির অভিমত, বনবিভাগের সহযোগিতা না থাকলে বন উজাড় ও বনভূমি দখল করা সম্ভব নয়। আবার ভূমি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা না থাকলে সরকারী খাস জমি দখল করা যায় না। এছাড়া পুলিশের সহযোগিতা না থাকলে বড় মাপের সন্ত্রাসী হওয়া যায় না। প্রবীণ ব্যক্তির অভিমত, একেবারে ফেলে দেয়া যায় না। কথায় আছে ‘পুরান চাউল ভাতে বাড়ে’। সম্প্রতি মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্তের কথায় জাতি আশান্বিত হলেও বনের গাছ রক্ষা পাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে? সারা দেশে বিজিবি, পুলিশসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যাপক তৎপরতা চালানোর পরও ইয়াবা পাচার বন্ধে কতটুকু সফলতা পেয়েছে তা জাতিই ভাল জানে। কোন কোন ক্ষেত্রে ইয়াবাসহ খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও গ্রেফ্তার হচ্ছে। পাতিলে ভাত রান্না করে মা ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েদেরকে ভাত না খেতে উপদেশ দিলেও ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েরা যেমন শোনবে না, তেমন অবস্থায় যেন না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। দেশের প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য যে পরিমাণ গাছের চাহিদা আছে, তা পূরণ না করে রাতারাতি গাছ কাটা বন্ধ করলে পরিণতি অনুরূপেই হবে। এরশাদ জামানায় বনের গাছ কাটার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গাছগুলো কি রক্ষিত আছে! কি পরিমান গাছ বর্তমানে পাহাড়ে বিদ্যমান আছে, তা দেখলেই অনুমান করা যায়। এছাড়া অতি পরিপক্ষ গাছগুলো সংরক্ষিত বনাঞ্চলে মরেও যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কৃত্রিম ভাবে বড় প্রকৃতির শতবর্ষী (মাদার ট্রি) মারা হচ্ছে। এসব গাছ রোধে শুকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ওই পোকার আধারে পরিণত হচ্ছে। বনবিভাগের ভাষায় এসব মরা গাছ আহরণও করা যাবেনা। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কাঠ চোরেরা এসব মূল্যবান গাছ রাতের আধারে কেটে পাচার করে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। প্রতিবছর ডাকঢোল পিটিয়ে বৃক্ষরোপন করা হলেও, বৃক্ষ উজাড়কে কি ঠেকানো যাচ্ছে? আর ক’দিন পর কক্সবাজার ও তিন পার্বত্য জেলার এক সময়ের ফসলি জমিতে শুরু হবে তামাক চাষ। এসব তামাক চুল্লিতে শুকাতে গিয়ে হাজার হাজার টন কচি ও বয়স বৃক্ষ লাকড়ী হিসেবে পোড়ানো হবে তার পরিসংখ্যান কি যথাযথ কর্তৃপক্ষ রাখে? দেশের কয়েকটি আলোচিত তামাক কোম্পানী নীল চাষের মত দেশের বিশাল একটি অংশ দখল করে নিচ্ছে। কিন্তু সরকার এক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থায় নিচ্ছে না। কারণ ওইসব তামাক কোম্পানী প্রতি বছর বিশাল অংকের টাকা সরকারের কোষাগারে রাজস্ব হিসাবে দিচ্ছে। যা হিসাব করলে “মন্দের ভাগ তিন চল্লিশ ভালোর সংখ্যা ৫৭ এর মতই”। অপরদিকে দুঃখ জনক হলেও সত্য সংরক্ষিত বন ভূমিতে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষই মিয়ানমারের নাগরিক। এদেশের জনপ্রতিনিধিদের অর্থপুর্ণ উধারতায় এরা বসতি স্থাপন ও বংশ বিস্তার করে যাচ্ছে নিরাপদে। যা দেখার কেউ নাই। আগামী ২০১৬ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বনাঞ্চলের বর্তমানে যে পরিমাণ গাছ আছে সে পরিমাণ গাছ দন্ডায়মান থাকলেও মনকে প্রভোদ দেয়া যাবে বর্তমান মন্ত্রী সভার আইনটি যথার্থ।
পাঠকের মতামত: